স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আজও বহাল তবিয়তে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররা
বিজয়ের মাসে যশোরের বাঘারপাড়া অঞ্চলের
একাধিক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর নামে মামলা হচ্ছে
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আজও বহাল তবিয়তে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররা। এখনো দেখতে হচ্ছে রাজাকার ও তার উত্তরসূরীদের ক্ষমতার দাপট! তা হলে কি কারণে এই দেশ স্বাধীন করেছিল আমাদের দেশের সূর্য সন্তানরা, এ প্রশ্নের জবাব খুজে পাচ্ছেনা বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা।
কোথায় তাদের এনে দেওয়া স্বাধীনতা? কথা গুলি খুব আক্ষেপের সাথেই বলছিলেন মাগুরা জেলার শালিখা এলাকার কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের এলাকায় এখনো রয়েছে সেই রাজাকারদের অবাধ বিচরণ। তারাই যেন আজ সমাজের হর্তাকর্তা। মনে হয় তাদের নির্দেশেই চলে আমাদের এলাকার সমাজ ব্যবস্থা। কিছু বলার নেই।
কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেই আসে মৃত্যুর হুমকি, হতে হয় শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার। আবার তারাই মনে করিয়ে দেয় ৭১ থেকে এখন পর্যন্ত তাদের ক্ষমতার কথা। কেউই তো কিছুই করতে পারে নাই। প্রতিবাদি অনেকেই এই ভয়তেও প্রতিবাদ করতে এখন আর সাহস পায় না।
তারা মনেই করে যুদ্ধের সময় লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, দখল কিই বা করেনি এই সব রাজাকারা, তার পরও স্বাধীন দেশেও ঈদখিয়ে চলেছে সেই একই ক্ষমতা। তাদের বিচার করার মত হয়তো কেউই নেই। যদি থাকত তা হলে হয়তো অনেক আগেই এদের বিচার হত।
হয়নি যখন তখন এরাই সবার থেকে বেশি ক্ষমতাধর
তবে আশার কথা এই যে, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর এবার যশোরের বাঘারপাড়া এবং মাগুরার শালিখা উপজেলার ২০ জনেরও অধিক যুদ্ধাপরাধীর নামে শিগগিরই মামলা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রটি জানিয়েছে আগামী বিজয় দিবসের আগেই এ মামলা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধীদের হাতে নিহত হন যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা, নারিকেলবাড়িয়া ও রায়পুর ইউনিয়ন এবং মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার তালখড়ি ও শতখালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের প্রায় অর্ধশতাধিক স্বাধীনতাকামী মানুষ। একই সাথে নিহতদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের কয়েকজন স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার দাবিতে মামলা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগও দাখিল করেছেন
জানা গেছে, যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার খালিয়া, ছোট খুদড়ো, নারিকেলবাড়িয়া, খানপুর, ভবানীপুর এবং মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার তালখড়ি ইউনিয়নের চতুরবাড়িয়া, পিয়ারপুর, ছান্দড়া এবং শতখালী ইউনিয়নের সীমাখালী, খোলাবাড়ি, আড়য়াকান্দি, ছয়ঘরিয়া ও হরিশপুর গ্রামের নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
অভিযোগে বাঘারপাড়া উপজেলার হুলিহট্ট, খুদড়ো, উত্তর চাঁদপুর, ভবানীপুর ও খানপুর গ্রামের এবং শালিখা উপজেলার পিয়ারপুর, খোলাবাড়ী, মেলেকবাড়ী, সীমাখালি, হরিশপুর, ছয়ঘরিয়া, পাঁচকাহুনিয়া গ্রামের শীর্ষ যুদ্ধপরাধীসহ ২০ জনের অধিক যুদ্ধাপরাধীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি বলেন ’৭১ এর পর থেকে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, এরা তাদের ছত্রছায়ায় যেয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে গেছে আজও যাচ্ছে।
বর্তমান সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুদ্ধাপরাধী মুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে একের পর যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে।
বিশেষ করে বাঘারপাড়া অঞ্চলের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আমজাদ মোল্যাসহ আরও বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে আদালতে। একই সাথে তদন্তও চলছে কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে। যারা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক প্রভাবশালী। তাই এবার যদি এ অঞ্চলের অপরাপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় তবে এই অঞ্চল হবে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত।
এখানকার মানুষ ভোগ করবে স্বাধীনতার অনন্য সুখ
একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পাবে দীর্ঘদিনের বিচার না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি।
মাগুরা জেলার শালিখা এলাকায় রামরাজত্ব চালান তৎকালীন রাজাকার বাহিনীর প্রধান মৃত গোলবার বিশ্বাস। তার রাজত্বে প্রধান সেনাপতি ছিল তার সন্তানরা। পিতার নির্দেশে তার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এলাকায় চালিয়েছে ধর্ষণ, হত্যা, লুট-পাটসহ বিভিন্ন নারকীয় কর্মযজ্ঞ। এতটাই হিংস্র ছিল এই গোলবার বিশ্বাসের সন্তানেরা যে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অপরাধে তারা আপন বৈমাত্রেয় বোনকেও নৃশংসভাবে হত্যা করতে বুক কাঁপেনি তাদের।
তারপরও আজও তারা এলাকায় বুক ফুলিয়ে চলে
তারা নাকি সরকারে দলের লোক! তাই আজো আতঙ্কে থাকতে হয় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের। আর ভয়ে বা আতঙ্কে থাকবেনই বা না কেন ? সীমাখালি বাজারের পার্শ্ববতী খোলাবাড়ি গ্রামের মোল্যা পরিবারের এক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী যার নির্যাতনে ওই এলাকা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হারিয়েছে একাধিক সূর্যসন্তানকে সেই সেই যুদ্ধাপরাধী যখন হয়ে যায় সরকারি দলের নেতা! হয় বাজার কমিটির (সীমাখালি বাজার বণিক সমিতি) শীর্ষনেতা।
তখন ভয় না পেয়ে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় কী ?
এমন আরো অনেকেই আছেন। যেমন সীমাখালি বাজারের গা লাগোয়া পিয়ারপুর গ্রামের বিশ্বাস পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ছিল পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসরদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওই এলাকার রাজাকার বাহিনীর শীর্ষপদটিও ছিল তাদের দখলে। সেই পরিবারের সদস্যরা আজ সীমাখালি বাজারের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। বাজার নিয়ন্ত্রক ঈদগাহ কমিটির নেতা ! তাদের বিরুদ্ধে যেয়ে ব্যবসা করা অসম্ভব। যার কারণে কেউ তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে সাহস পায় না। ভয়কে উপেক্ষা করে কেউ প্রতিবাদ করলে তার উপর নেমে আসে নির্যাতনের পাহাড়। শতখালী গ্রামের অপর এক শীর্ষ রাজাকার বর্তমানে এলাকা ছেড়ে পাবনার একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপলের দায়িত্ব পালন করছে। তার বিবিও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা। যার বাবা ছিলেন তৎকালীন সময়ের পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর ওসি। এলাকা ছেড়ে যশোর ও ফরিদপুরে স্থায়ী হয়েছেন আরো কয়েকজন রাজাকার। যাদের কেউ কেউ মওলানা সাহেব নামে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছেন। আবার কেউ বা ভদ্র ব্যবসায়ী সেজে ব্যবসা করে চলেছেন।
এ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার বিষয়ে কথা বললে স্থানীয় জেলা পরিষদের সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা কাশেম মিনা জানান, যুদ্ধাপরাধীরা দেশের শত্রু কিন্তু তারাই আজ কিভাবে যেন আমাদের বন্ধু সেজে আজো আমাদের পিঠে ছুরি মারছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার থেকে বিচার চাওয়া হলে আমরা অবশ্যই তাদের পাশে থাকবো। কেননা যুদ্ধাপরাধীরাই আমাদের স্বাধীনতাকে আজো বাঁধাগ্রস্ত করে চলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমাখালি বাজার কমিটির এক নেতা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়াটা কষ্টের।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বাঘারপাড়ার বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সবদুল হোসেন খান বলেন, ৫০ কেন ১০০ বছর পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত।
আজ যারা তাদের স্বজনদের হত্যার বিচার দাবি করছেন আমি তাদের পাশে আছি। যুদ্ধাপরাধীরা মহান মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করে আমাদের স্বাধীনতাকে রুখে দিতে চেয়েছিল। আমার ইউনিয়নের কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে। আরও যারা আছে তারাও দ্রুত বিচারের আওতায় আসুক। ক্ষতিগ্রস্তরা এতদিন পরে এসে হলেও এতটুকু স্বস্তি পাক যে তারা তাদের স্বজন হত্যার বিচার পেয়েছেন।
উল্লেখ্য, অতিসম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি তদন্ত দল বাঘারপাড়ার কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর মামলা তদন্তে আসলে যশোর সার্কিট হাউসে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নেতৃবৃন্দের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে আক্ষেপ করে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বহু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু সে তুলনায় মামলা অনেক কম।
এ কথা জানার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, ঘাদানিক নেতৃবন্দ, বিশিষ্টজন ও সাংবাদিকরা ওই সকল এলাকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে মামলা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং বিচারের জন্য তাদেরকে সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিলে একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার মামলা করতে সম্মত হয় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আবেদন জমা দেয়।
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
H R S